কিশোর যোদ্ধার ঈদ

অলংকরণ: আবু হাসান

নভেম্বরের শেষ দিকের এক ভোরবেলা। একাত্তরের কথা বলছি। তখন কিন্তু বেশ শীত পড়ত নভেম্বরেই। তো সেই সকালে কিছু কিশোর হাজির হলো ঢাকার পাশের বেরাইদ গ্রামে। গায়ে কাদামাটি। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি কিংবা হাওয়াই শার্ট। কারও গায়ে কেবল একটা গামছা। সবার লক্ষ্য—নিরাপদ একটা আশ্রয়। দিনে প্রকাশ্যে চলাফেরা করাটা তাদের জন্য বিপজ্জনক। কারণ, তারা মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযোদ্ধাদের একজন শামসুল আলম রিজভী। নিদ্রাহীন রাতের ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট এই কিশোর যোদ্ধার চোখেমুখে। সহযোদ্ধারা অধিনায়ক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে মনে করিয়ে দিল, ‘মায়া ভাই, মানুষজন তো ঘরের বাইরে আসতে শুরু করেছে।’

দ্রুত কয়েকটি বাড়িতে ভাগ হয়ে আশ্রয় নিল তারা। রিজভী ছিল মায়ার সঙ্গে। সকাল সাতটা কি সাড়ে সাতটা; দেখে গ্রামের মানুষ পাজামা-পাঞ্জাবি পরে টুপি মাথায় একদিকে যাচ্ছে। সহযোদ্ধারা নিশ্চুপ। ব্যাপার কী? রিজভীর প্রশ্ন।

গ্রামের মানুষ জানাল, আজ ঈদ। আমরা ঈদের নামাজ পড়তে যাচ্ছি। আপনারা যাবেন?

মন চাইলেও তা অসম্ভব। এখানে তারা আগন্তুক। রাজাকাররা টের পেলে বিপদ হবে। পুরো দিনই তাদের লুকিয়ে থাকতে হবে স্বাধীনতার পক্ষের কোনো বাড়িতে।

এই সময় অবিশ্বাস্য মনে হবে ঘটনাটা। একাত্তরে ছিল বাস্তব। কারণ, ওই যোদ্ধাদের হিসাব ছিল না, রোজা কবে শেষ হবে, কখন ঈদ হবে। থাকার কথা কি?

ঈদের আগের রাতের একটা ঘটনার কথা বললে স্পষ্ট হবে।

অধিনায়ক মায়ার নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা ঢাকার মাতুয়াইল ও আশপাশের গ্রামগুলোতে অবস্থান নিল। ঢাকায় আক্রমণ চালিয়ে আবার নিরাপদে সেসব গ্রামে আশ্রয় নেওয়াই উদ্দেশ্য। রিজভী তখন মাতুয়াইল এলাকায়। অধিনায়ক খবর পাঠালেন, রিজভীরা যেন মেরাদিয়া বা ত্রিমোহিনী এলাকায় তার সঙ্গে দেখা করে। ঢাকা শহর-লাগোয়া গ্রাম এলাকা সেটা। গ্রামের পথ ধরে হাঁটা কিছুটা নিরাপদই ছিল। শেষ রাতে তুলনামূলক আরও নিরাপদ। তারা এল নন্দীপাড়া-ত্রিমোহিনী এলাকায়। তখন আনুমানিক ভোর চারটা। মুক্তার ও অলি নামের আরও দুজন মুক্তিযোদ্ধা তার সঙ্গে।

অধিনায়ক চুপচাপ। বোঝা গেল, ওই মুহূর্তে কথা বলা নিষেধ। ইশারায় তিনি বললেন, ‘চলো।’ সামনের খালে নৌকা। বললেন, ‘প্রিন্স (রিজভী) ও অলি নৌকা চালাও।’ হাতের ইশারায় পথ নির্দেশ করছে সে। রিজভীর অস্ত্র এলএমজি, অধিনায়কের কাছে মর্টার। মেরাদিয়া খাল দিয়ে এগিয়ে চলছে নৌকা। কিছুদূর যাওয়ার পর বোঝা গেল, রামপুরা টিভি সেন্টারের দিকে যাচ্ছে তারা। অপারেশন হবে টিভি সেন্টারে থাকা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। এর মধ্যে টিভি টাওয়ারের লাল বাতিটা স্পষ্ট হতে থাকে।

রামপুরা থেকে কিছুটা পেছনে নিরাপদ জায়গা দেখে তাদের নৌকা থামে। সামান্য ঝোপঝাড়। কিন্তু কাদামাটি। এখানে অবস্থান নিলে কাদা থেকে বাঁচার পথ নেই। তবু অধিনায়কের নির্দেশ। অধিনায়ক স্থান নির্ধারণ করে দিলেন, কে কোথায় থাকবে। অল্প সময়ের মধ্যে মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া শেষ। অধিনায়কই মর্টার ছুড়লেন রামপুরা টিভি সেন্টারে। কিন্তু কেন যেন কিছুটাসময়নিলেন এলএমজি ফায়ারের নির্দেশ দিতে। অলি ও মুক্তার মনে হয় নির্দেশের অপেক্ষাই করছিল। কয়েক দফা মর্টার নিক্ষেপের পরই শুরু হলো এলএমজি ফায়ার।

পাকিস্তানিরা ততক্ষণে পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করেছে প্রচণ্ড বেগে। গুলি কাকে বলে! মর্টারও চলছে সমান তালে। এর মধ্যেই ভোর হয়ে এল। স্বাভাবিক কারণেই ওই জায়গা ত্যাগ করতে হবে। নির্দেশ এল পিছু হটার। কিছুটা সময় চলে গেল এলএমজি গুটিয়ে নিতে। মর্টার গুটিয়ে নিতেও সময় লাগছে। অধিনায়কের তাড়ায় দ্রুত পিছু হটে তারা। ততক্ষণে সূর্য উঠি উঠি। দ্রুত নৌকা চালিয়ে অদূরে বেরাইদ গ্রামে গিয়ে পৌঁছায় দলটি।

এখানে এসেই জানতে পারল, আজ ঈদের দিন। কিশোর রিজভীর মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে। খুব মনে হতে থাকে মায়ের কথা, ভাইবোনদের কথা। লুকিয়ে গিয়ে বাসার সবাইকে দেখে আসবে সেটাও ঝুঁকিপূর্ণ। কদিন আগে বাসায় গিয়ে তো প্রায় ধরাই পড়েছিল। অবশ্য একটু বেশিই সাহস করে ফেলেছিল সেদিন। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার বাসায় গিয়ে দেখে মা নেই। তখন বাসে চড়ে রওনা হয় সদরঘাটে। সেখান থেকে যাবে পুরান ঢাকায় পালিয়ে থাকা মায়ের কাছে। বাস সদরঘাটে পৌঁছানোর আগেই একজন পেছন থেকে শার্ট ধরে টান দেন। কানের কাছে এসে বলেন, ‘কথা না বলে আমাকে ফলো করো।’

সম্মুখ লড়াইয়ে কিশোর যোদ্ধা রিজভীর দূর্লভ ছবি (বৃত্ত চিহ্নিত)

তর্ক করার সুযোগ নেই। কারণ, তাঁর শার্টের নিচে রাখা আছে অস্ত্র। বাস থেকে নেমে লোকটিকে অনুসরণ করল সে। কিছুদূর যাওয়ার পর লোকটি দাঁড়িয়ে বলেন, ‘তোমার মা ওই বাসায় আছে। খবরদার দিনের বেলা বের হবে না।’ সেই সময় মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঠিকই। মা নিশ্চিত হয়েছিলেন তাঁর ছেলে বেঁচে আছে। কদিন আগে তিনি খবর পেয়েছিলেন রিজভী নাকি বর্ডারেই পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে। রিজভীর খালাতো ভাই আফতাবুল কাদের (পরবর্তী সময়ে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত) শহীদ হয়েছেন। সেই খবর পেয়ে মা ধরেই নিয়েছিলেন তাঁর ছেলের পরিণতিও তেমনই হয়েছে। রিজভীকে দেখে মা আশ্বস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ঈদের দিনও ছেলে থাকছে না মায়ের কাছে? নিশ্চয়ই মা ঈদ করতে পারবেন না।

তারপরও কি আর মায়ের কাছে যাওয়া সম্ভব?

মা-ভাইবোনদের নিয়ে ঈদ করতে না পারার কষ্ট নিমেষেই মিলিয়ে গেল রিজভীর। গত রাতে রামপুরা টিভি সেন্টার আক্রমণকালে যেভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলির মুখে পড়েছিল, বেঁচে থাকাটাই তো বড় পাওয়া। আর তাকে যে বেঁচে থাকতে হবে দেশটা স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত। এটাই যে ঈদের বড় স্বপ্ন।

সহযোদ্ধাদের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছিলেন অধিনায়ক মায়া। কিছুটা হাস্যরস করে বললেন, ‘দাঁড়াও, আমরাও ঈদ করব।’

কিন্তু সেটা কি সম্ভব? দিনের বেলা কাটাতে হয় ঘুমিয়ে আর লুকিয়ে থেকে। সেখানে ঈদ হবে কী করে।

যতটা মনে আসে, পাঁচ টাকা দিলেন অধিনায়ক মায়া। বললেন, ‘দেখ গ্রামে কোথাও গরু জবাই হয়েছে কি না।’ সেই টাকায় কয়েক সের গরুর মাংস আনল স্থানীয় একজন। সেগুলো একটি বাড়িতে দেওয়া হলো রান্না করতে। কিন্তু কেউই আর ঈদের নামাজ পড়তে পারল না। ঘুম থেকে জেগে আশপাশের কয়েক বাড়ি থেকে আসা ফিরনি আর মাংস-ভাত খেয়ে ঈদের কিছুটা আনন্দ উপভোগ করল। আর কামনা করল, পরের ঈদটা যেন হয় স্বাধীন বাংলাদেশে। হয়েছিলও তা-ই।